রফিকুল ইসলাম। পেশায় চাকুরিজীবী। থাকেন মিরপুর পীরেরবাগ এলাকায়। গত দশ বছরে জীবন যাত্রার ব্যয় কেমন বেড়েছে? নাকি স্থিতিশীল ছিলো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ব্রেকিংবিডিনিউস বলেন, ‘কি না বেড়েছে? কোথায় বাড়েনি? সবকিছুইতো বেড়েছে। চাল ডাল আটা থেকে শুরু করে বাসা ভাড়া গ্যাস বিদ্যুৎ সব কিছুর দামই বেড়েছে।
তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে যে বাসায় ভাড়া থাকতাম সেখানে ভাড়া দিতে হতো ৫ হাজার ৮শ টাকা। এখন সে বাসার ভাড়া হলো ১৪ হাজার টাকা। ব্যবধানটা হিসেব করে বের করে নিন।’
রফিকুল ইসলামের মতো একই বক্তব্য পাওয়া গেলো বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে আলাপ করে। গত ১০ বছরে ধারবাহিকভাবেই বেড়েছে মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয়। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য থেকে ভোগ্য পন্য সব কিছুরই দাম উঠা নামা করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত এই দামের বাজার নিন্মমুখী হয়নি বরং উল্টোটা হয়েছে, বেড়েছে। চালের বাজার থেকে বিলাসী পণ্যের বাজারের চিত্রও একই। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কখনো কখনো এমন লাগামহীনভাবে বেড়েছে যে নিন্ম আয়ের মানুষের জন্য সেই সময়টা কাটিয়ে ওঠাই দূরহ হয়ে উঠেছিলো। চালের বাজার কখনো কখনো ছিলো লাগামহীন অস্থিরতা। সরকারের বিক্রি করা খোলা বাজারের চালের দামের সাথে বাজারের দামের পার্থক্যও ছিলো বেশ।
একইভাবে বেড়েছে বিদ্যুৎ, গ্যাস, তেলের দামও। প্রায় সবক্ষেত্রেই বেড়েছে জীবন যাত্রার ব্যয়। ২০০৮ সালে মোটা চালের দাম রেকর্ড ভাঙে অতীতের। তখন মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৩৬ থেকে ৪০ টাকায়। এরপর আস্তে আস্তে চালের দাম কমে। কিন্তু আবার তা বাড়তে শুরু করে। কয়েক দফা চালের দাম ওঠা নামা করার পর গত বছর ২০১৭ সালে সব রেকর্ড ভেঙে চালের দাম আকাশচুম্বি হয়। ২০১৭ সালে এক বছরেই বেশ কয়েক দফায় চালের দামে বেড়ে সর্বোচ্চ ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছ মোটা চাল।
ক্যাবের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সব ধরনের চালের গড় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ।
এরপর সরকার খোলা বাজারে চাল বিক্রির উদ্যোগ নিলে দাম কমে আসে। স্থিতিশীল হয় বাজার। তবে সময় ভেদে বেড়েছে কমেছে দাম। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে মোটা চাল বিভিন্ন স্থানে বাজার ভেদে বিক্রি হয়েছে ৩৮ থেকে ৪২ টাকায়। জুন মাসে চালের বাজারের হিসাব অনুযায়ী মোটা চাল ৪০ থেকে ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কাওরান বাজারের বিক্রেতা নুরুল হক বলেন, ‘যে চালের কথা জানতে চাচ্ছেন ৪০ টাকা কেজি (মোটা চাল) ওইটা এখন খুব বেশি পাওয়া যায় না। বাজারে কম আছে। সাধারনত ৪৪/৪৫ টাকা দরের চালটাই বিক্রি হচ্ছে।’
কাওরান বাজারসহ রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে নুরুল হুদার কথার সত্যতা পাওয়া গেলো। গুটি স্বর্ণা নামের যে চাল ৪০ থেকে ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে তা বেশির ভাগ বিক্রেতার কাছেই পাওয়া গেলো না।
খোলা বাজারে সয়াবিন তেলের দাম নিয়েও ছিলো একই রকম অস্থিরতা। ২০০৬ সালে সয়াবিন তেল খোলা বাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৬০-৬২ টাকায়। ২০০৮-এ তা বিক্রি হয় ১০৫-১১০ টাকায়। এভাবে দাম ওঠা নামা করে ২০১৫ সালে এসে আবার দাম কমে বিক্রি হয়েছে ৭১ থেকে ৭২ টাকায়। বর্তমানে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে বাজার ভেদে ৮৮ থেকে ৯২ টাকায়।
এটা গেলো শুধু চাল-তেলের হিসেবে। কাঁচা বাজারে মাছ মাংসের দামও বেড়েছে কয়েকগুন। ২০০৬ সালে প্রতিকেজি গরুর মাংস ছিলো ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা। ২০১২ সালে গরুর মাংস ২৭০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। ২০১৮ সালে এসে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪৭০ থেকে ৪৮০ টাকায়। খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭২০ টাকায়। যা ২০১২ সালে বিক্রি হয়েছে ৪৩০ টাকায়। গত এক দশকের ভেতর এভাবেই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও বেড়েছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও। এগুলো বাড়ার সাথে সাথে জীবন যাত্রার ব্যয়ও নানাভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত ১০ বছরে অর্থ্যাৎ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন সরকারের দুই মেয়াদে আট বার বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। গ্যাসের দামও বেশ কয়েক দফা বেড়ে দ্বিগুন হয়েছে। আবাসিক বাসা বাড়িতে ২০০৮ সালে গ্যাসের দাম ছিলো ৩৫০ টাকা ও দ্বিমুখো চুলায় ৪০০ টাকা। এরপর ৩ দফা দাম বাড়ানোর পর বর্তমানে আবাসিক গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে এক চুলার জন্য ৭৫০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য আটশো টাকা।
২০০৯, ২০১৫ ও ২০১৭ সালে এই ৩ দফা বাড়ে গ্যাসের দাম। ২০০৯ সালে আবাসিকে গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ায় একমুখো চুলায় ৪০০ ও দ্বিমুখী চুলায় ৪৫০ টাকা। মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৫ টাকা ১৬ পয়সা। এরপর ২০১৫ সালে আবার দাম বাড়ালে একমুখো চুলার বিল দাঁড়ায় ৬০০ ও দ্বিমুখী চুলায় ৬৫০ টাকা। এরপর ২০১৭ সালে আরেক দফা বাড়ে। সরকার আরো একদফা গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেও ক্যাবের এক রিট আবেদনের প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টে তা স্থগিত হয়।
বাংলাদেশে ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষন ও প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় স্বেচছাসেবী প্রতিষ্ঠান কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর তথ্য অনুসারে ২০০৯ সালে থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়েছে মানুষের। ২০০৯ সালে ঢাকা মহানগরীতে জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে ৬.১৯ শতাংশ, ২০১০ সালে বেড়েছে ১৬.১০ শতাংশ, ২০১১ সালে বেড়েছে ১২.৭৭ শতাংশ, ২০১২ সালে বেড়েছে ৬.৪২ শতাংশ, ২০১৩ সালে বেড়েছে ১১ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৬.৮২ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৬.৩৮ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ৬.৪৭ শতাংশ। ২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ ও পণ্যমূল্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।
দৈনন্দিন জীবনের খরচ বাড়তে বাড়তে কোথাও কোথাও নাভিশ্বাস হওয়ার উপক্রম। শিক্ষা থেকে চিকিৎসা সবকিছুর দামই বেড়েছে। ৯ বছর আগে যে বাসা ভাড়া দিতে হতো সাড়ে ৮ হাজার টাকা সেই বাসা এখন ভাড়া দিতে হচ্ছে ১৩ হাজার টাকা।
রামপুরার বাসিন্দা সাব্বির সোহান বলেন, ১০ বছরের ব্যবধানে বাসা ভাড়া বেড়েছে আমার এলাকায় গড়ে ৪ হাজার টাকা। মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান বলেন, ‘গত ৭ বছরের ব্যবধানে আমার বাসা ভাড়া বেড়েছে আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা। আশে পাশে সবারই একই হারে বেড়েছে ভাড়া।’
নগর পরিবহন খরচও বড়েছে দ্বিগুনেরও বেশি। বাস ভাড়া থেকে রিকশা ভাড়া সবই বেড়েছে। রিকশা ভাড়া দ্বিগুন থেকে তিনগুনও হয়েছে কোন কোন এলাকায়। আগে যেখানে বাস ভাড়া দিতে হতো ৫ টাকা সেখানে ভাড়া হয়েছে ১০টাকা। রিকশা ভাড়াও বেড়েছে দ্বিগুন। ২০ টাকার ভাড়া নিচ্ছে ৪০ টাকা।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আগে যেখানে লেগুনা ভাড়া দিতে হতো ৭ টাকা সেটা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ টাকায় আর ১০ টাকার ভাড়া হয়েছে ১৮ টাকা। এভাবেই দৈনন্দিন জীবনে নানা ক্ষেত্রেই বেড়েছে ব্যয়ের হিসেব।
রামপুরা এলাকার রিকশা চালক শওকতের সাথে রিকশা ভাড়া নিয়ে দরদামের এক পর্যায়ে বলেন, ‘আপনারা যে যদি ভাড়া বাড়ায়ে না দেন খাবো কি? সব কিছুরই তো দাম বাড়ছে। রিকশা ভাড়া না বাড়লে আমরা বাঁচবো কেমনে?’